ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপের আজ ভোট । এরইমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাগজে-কলমে নেই আওয়ামী লীগ। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌকা প্রতীক ছাড়াই আওয়ামী লীগের এমপিরা যে যার মতো করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছেন। প্রথম দফায় ১৩৯টি উপজেলা নির্বাচনে আজ লড়াই হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগে। যদিও ৫৮ টি উপজেলায় বিএনপির প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ কারণে ইতোমধ্যে বিএনপি তাদের সবাইকে বহিষ্কার করেছে। এরপরও একাধিক স্থানে বিএনপিরও একাধিক প্রার্থী রয়েছে। গড়ে প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিনজন করে। যেখানে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হচ্ছে অর্থাৎ সমঝোতার মাধ্যমে মন্ত্রী এবং এমপিরা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিদেরকে প্রার্থী করেছেন এবং অন্য প্রার্থীদেরকে বসিয়ে দিয়েছেন এরকম প্রায় ৬৭ টি উপজেলায় এবার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াই করছে আওয়ামী লীগ। এতে দেশের কোথাও কোথাও সহিংস রূপ নিয়েছে। উপজেলা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন উপজেলায় সহিংসতা দেখা যাচ্ছে। মূলত উপজেলা নির্বাচনে লড়াই হচ্ছে মন্ত্রী-এমপিদের মাইম্যান বনাম আওয়ামী লীগের তৃণমূলের। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উপজেলায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের মাইম্যানদেরকে নির্বাচিত করার জন্য মাঠে নেমেছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন বারবার ঘোষণা করছে, মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না বা প্রচারণা চালালে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের কলকাঠি মন্ত্রী-এমপিরাই নাড়ছেন। তারা এলাকায় যাচ্ছেন না, সরাসরি নির্বাচনে প্রচারণা করছেন না এটা যেমন সত্য। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে, তাদের সমর্থক, কর্মী এবং নিজস্ব লোকজনকে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য মাঠে নামিয়েছে। ঢাকায় বসেই মন্ত্রীরা নির্বাচনের তদারকি করছেন, নিশ্চিত করতে চাইছেন যে, নিজের পছন্দের ব্যক্তি যেন জয়ী হয় অন্যদিকে তৃণমূলের জন্য এই নির্বাচন একটি অগ্নিপরীক্ষা। অস্তিত্বের পরীক্ষাও বটে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন যে, দলের ভিতর যে জমিদারতন্ত্র এবং আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মন্ত্রীদের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একটাই রাস্তা, সেটি হল নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এবং জয়ী করে দেয়া। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যে আবহ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায় তাতে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে এজন্য ওপর থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। কোন মন্ত্রী-এমপির বা কোন প্রার্থীর পক্ষে যদি কেউ কাজ করে তাহলে না বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও সাফ ঘোষণা করা হয়েছে। আর একারণ বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউই ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছেন না। প্রশাসনও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কারণ নির্বাচন কমিশনের নজরদারি রয়েছে। আর এ কারণেই উপজেলা নির্বাচনে মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে মন্ত্রী-এমপিদের নিজস্ব লোক নাকি তৃণমূল আওয়ামী লীগ।
উপজেলা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তরাই প্রভাব বিস্তারে: মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আসিবুর রহমান আসিব খান। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের বড় ছেলে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাভেলুর রহমান শফিক খান, যিনি শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এই নির্বাচনি এলাকায় দুই প্রার্থী একে অন্যের বিরুদ্ধে ‘প্রভাব বিস্তারের’ অভিযোগ করেছেন। আসিবুর রহমানের অভিযোগ, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে প্রভাব দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে শফিক খানের অভিযোগ, শাজাহান খান তার ছেলের পক্ষে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। এরমধ্যে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ, কালো টাকা ছড়ানোর কারণে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তবে পাল্টাপাল্টি এই অভিযোগ শুধু মাদারীপুরের নয়, প্রথম ধাপের ভোটে অনেক উপজেলায় প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ বিভিন্ন প্রার্থীর। কোথাও স্বজনদের জন্য মাঠে নেমেছেন মন্ত্রী-এমপি, কোথাও নিজের ‘মাই ম্যানের’ জন্য মাঠে নেমেছেন তারা; আবার কোথাও দলের কেন্দ্রীয় নেতারাই জড়িয়ে পড়েছেন প্রভাব বিস্তারে। যাদের দায়িত্ব প্রভাবমুক্ত রাখা, তারাই জড়িয়ে পড়েছেন প্রভাব বিস্তারে। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের একজন হয়েও তিনি জড়িয়ে পড়েছেন নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনে। অভিযোগ উঠেছে, আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধেও। আবার সাংগঠনিক বিষয় দেখার দায়িত্ব যে সাংগঠনিক সম্পাদকের, সেই পদে থাকা নেতা মির্জা আজমেরও নাম এসেছে এলাকার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে।
কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বশীল দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে দলের দায়িত্বশীল নেতারা কথা বলতে চান না। ‘কী বলে কার শত্রু হবেন’ এ নিয়ে শঙ্কায় থাকেন তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয় দেখভালের জন্য যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের তুলনায় দলের নির্দেশ অমান্যকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারাও কথা বলতে চান না। গণমাধ্যমেও এই বিষয়ে তাদের মুখে কুলুপ আটার মতো অবস্থা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, কথা বলে বিপদে পড়ে লাভ কী? তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের কাছেও অসহায় হয়ে পড়ছেন তারা।
প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের সংখ্যা ১৩ জন: জানা গেছে, ইতোমধ্যে অভিযোগ এসেছে যেসব এলাকায় বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা নির্বাচন করছেন সেসব এলাকায়। প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন ১৩ জন। ভাই, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, জামাতা, ভাইয়ের ছেলে আছেন তালিকায়। মাদারীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আসিবুর রহমান, সুবর্ণচর উপজেলার আতাহার ইশরাক চৌধুরী, সারিয়াকান্দি উপজেলার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, বেড়া উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আব্দুল বাতেন ও আব্দুল কাদের, নাজিরপুর উপজেলার এস এম নূর ই আলম, সোনাতলা উপজেলার মিনহাদুজ্জামান, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সফিকুল ইসলাম ও আলী আফসার, কুষ্টিয়া সদরের আতাউর রহমান, ধনবাড়ী উপজেলার হারুন অর রশীদ, মাদারীপুর সদরের পাভেলুর রহমান এবং রামগড় উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিশ্ব প্রদীপ কারবারী। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও এমপি শাহাজান খানের পুত্র ও চাচাতো ভাই প্রার্থী হয়েছেন। প্রার্থী আছেন সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের পুত্র ও ছোট ভাই। সংসদ সদস্য একারামুল করিম চৌধুরী পুত্রও প্রার্থী আছেন। ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই ও ভাইয়ের ছেলে প্রার্থী আছেন। আরও প্রার্থী আছেন সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই, শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই, মাজহারুল ইসলামের চাচা ও চাচাতো ভাই, মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই এবং কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার জামাতা।
দলীয় সূত্রমতে, মূলত ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় প্রার্থী না দেয়ার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে নির্বাচনের মাঠে না থাকেন, সেই ধরনের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। তবে দু’একজন দলীয় নির্দেশ মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও বড় একটি অংশ মাঠ থেকে সরেনি। এ নিয়ে প্রথমে কঠোর অবস্থানে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নমনীয় হয়েছে দলটি। তবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু রাখতে যাতে কেউ যাতে প্রভাব বিস্তার না করে সেজন্য প্রতিনিয়ত দলীয় নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। একটি অংশগ্রহণমূলক ভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে দলটি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের অনেকে প্রত্যাহার করেছেন। আর যারা নির্বাচনের মাঠে আছেন তারাও কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। সে অনুযায়ী কাজও করছি আমরা। একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, দল হিসেবে আমরা সেটিই চাই। তবে বিভিন্ন জায়গায় সংসদ সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ আসছে। ভোটের মাঠে প্রকাশ্যে না থাকলেও বেশিরভাগ সংসদ সদস্য ভেতরে-ভেতরে প্রভাব বিস্তার করছেন। এমনকি তারা নিজেদের ‘অনুগত’ প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নেতাকর্মীদের ফোনে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ ধরনের অভিযোগ তুলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা তাদের আস্থাভাজনদের জয় নিশ্চিত করতে প্রভাব বিস্তার করছেন। বিভিন্ন উপজেলা থেকে এমন অভিযোগ আসছে।
আ’লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আ’লীগ: আজ ৮ মে ৪ ধাপে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হচেছ। এসব উপজেলায় মূলত লড়াই হবে আওয়ামী লীগ বনান আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তারমধ্যে রয়েছে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে লড়াই হবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের। এখানে নির্বাচনে ২ জন চেয়ারম্যান, ৩ জন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেরানীগঞ্জ উপজেলায় যারা বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের। চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি টানা তিন বারের উপজেলা চেয়ারম্যান। উপজেলা চেয়ারম্যান পদের অপর প্রার্থী কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বিপ্লব। তিনি কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত হন তিনি। এই দুই প্রার্থীই স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতিতে যেমন পদধারী তেমনি তাদের মাথায় ছায়া রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও বিদ্যুৎ ও জ¦ালানীমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। একই অবস্থা রাজনীর বাইরেও।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

# প্রভাবমুক্ত রাখা দায়িত্বপ্রাপ্তরাই জড়িয়ে পড়েছেন প্রভাব বিস্তারে # প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের সংখ্যা ১৩ জন
উপজেলা নির্বাচনে আ’লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আ’লীগ
- আপলোড সময় : ০৮-০৫-২০২৪ ০২:২৯:০৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৮-০৫-২০২৪ ০২:২৯:০৫ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ